আন্তর্জাতিক নারী দিবস রচনা ২০২১

আন্তর্জাতিক নারী দিবস

আন্তর্জাতিক নারী দিবস রচনা
আন্তর্জাতিক নারী দিবস রচনা

সংকেত: ভূমিকা; আন্তর্জাতিক নারী দিবস; ইতিহাস; নারীর বর্তমান অবস্থা; নারী উন্নয়নের পথে বাধাসমূহ; নারী উন্নয়নে করণীয়; বাংলাদেশে নারী দিবস; দিবসটির সমালোচনা; দিবসটির তাৎপর্য; উপসংহার।

ভূমিকা: কোনো কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারী, প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয়ী লক্ষ্মী নারী। -কবি নজরুল ইসলাম পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। এই নারীর অবদান পুরুষ কখনই অস্বীকার করতে পারবে না। পুরুষের প্রতিটি সৃষ্টিকর্মের মধ্যে রয়েছে নারীর ভূমিকা। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের উপরিউক্ত বিখ্যাত চরণদুটি আমাদেরকে একথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। অথচ যুগ যুগ ধরে নারীর এই অবদানকে অবদমিত করে রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারী সমাজের মুক্তির একটি পদক্ষেপ মাত্র।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস: প্রতি বছর ৮ মার্চ সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। দিবসটির পূর্ব নাম ছিল ‘আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস’। বিশ্বব্যাপী এই দিবস পালনের কেন্দ্রীয় বিষয় নারী। কিন্তু আঞ্চলিক ভিত্তিতে দিবসটি পালনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভিন্ন রকম হয়। কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ প্রাধান্য পায়, আবার কোথাও নারীর আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা বেশি গুরুত্ব পায়। কোথাও বা নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার বিষয়টিকে মুখ্য হিসেবে রেখে দিবসটি উদযাপিত হয়।

ইতিহাস: ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নারীদের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। এ দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের একটি সূচ তৈরি করখানার নারী শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করেন। কারখানার মানবেতর পরিবেশ, ১২ ঘণ্টার কর্মসময়, অপর্যাপ্ত বেতন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বিরুদ্ধে তাদের এক প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। কিন্তু পুলিশ এই শান্তিপূর্ণ মিছিলে মহিলা শ্রমিকদের উপর নির্যাতন চালায়। বহু শ্রমিককে আটক করা হয়। এই ঘটনার স্মরণে ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ মহিলা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করে নিউইয়র্ক সূচ শ্রমিকেরা। এভাবেই সংঘবদ্ধ হতে থাকে মহিলা শ্রমিকদের আন্দোলন। এক সময় তা কারখানা ও ইউনিয়নের গন্ডি অতিক্রম করে। ১৯০৮ সালে জার্মান সমাজতন্ত্রী নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় জার্মানিতে। এই সম্মেলনে নারীদের ন্যায্য মজুরী, কর্মঘণ্টা এবং ভোটাধিকারের দাবী উত্থাপিত হয়। ১৯১০ সালের ২য় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ডেনমার্কের কোপেনহেগেন-এ। এতে ১৭টি দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দেয়। এ সম্মেলনেই ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯১১ সালে প্রথম ৮ মার্চ দিবসটি পালিত হয়। ১৯১৪ সাল থেকে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে দিবসটি বেশ গুরুত্বের সাথে পালিত হতে থাকে। ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘ দিবসটি পালন করতে থাকে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দিবসটি পালনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয় ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এ সময় জাতিসংঘ দিবসটির গুরুত্ব উপলব্ধি করে জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দিবসটি পালনের আহবান জানায়। এর ফলে অধিকার বঞ্চিত নারী সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির পথ সুগম হয়। নারীর অধিকার রক্ষা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এটি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

নারীর বর্তমান অবস্থা: বর্তমান যুগকে বলা হয় গণতান্ত্রিক যুগ, সমতার যুগ। কিন্তু এ সময়েও নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নারীরা এখন কাজের জন্য ঘরের বাইরে যাচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গবেষণা, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই নারীর পদচারণা লক্ষণীয়। কিন্তু তারপরও নারীরা এখনও বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। পরিবারের মধ্যে আপনজন কর্তৃক নারীর নির্যাতিত হওয়া ঠেকানো যাচ্ছে না। কর্মস্থল, পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থায়, পথেঘাটে নারীরা বিভিন্নভাবে ইভ টিজিং এবং যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। নারী দিবস উদযাপন করে এসব অবস্থার উন্নতি করা না গেলেও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নারী নির্যাতন অনেক হ্রাস পেয়েছে। নারীর নিরাপদ কর্ম পরিবেশ, কর্মঘণ্টা, মজুরি ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত করা গেছে অনেক ক্ষেত্রেই। সারাবিশ্বে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে এই দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নির্যাতন প্রতিরোধ এবং নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারী উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু বিভিন্ন দেশে এ ক্ষেত্রে এখনও বহু বাধা রয়েছে। এই বাধাগুলির মধ্যে প্রধান হলো- – নারী উন্নয়নের প্রথম এবং প্রধান বাধা হলো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে সব সময় পুরুষের অধীন এবং ছোট করে দেখা হয়। – সামাজিক কুসংস্কার নারীর অগ্রগতিকে মেনে নিতে পারে না। এটিও নারী উন্নয়নের পথে এক বড় অন্তরায়। – নারী যদি শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হয় তবে সে সচেতন হয় না। তার আয় বাড়ে না। ফলে সে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়। এরূপ অবস্থা নারীকে দুর্বল করে দেয়। – নারীর ক্ষমতায়ন না থাকা। – নারীর কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকা। – কৃষিভিত্তিক সমাজ।

নারী উন্নয়নে করণীয়: নারী উন্নয়ন বলতে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং কাজের যথাযথ মূল্যায়নকে বুঝানো হয়। নারী উন্নয়নে সমাজ ও রাষ্ট্রকে একসাথে কাজ করতে হবে। এজন্য করণীয় হলো- – নারীর প্রধান শক্তি হলো শিক্ষা। নারীশিক্ষার বিস্তার ঘটলে নারীর কর্মসংস্থান হবে, আয় বাড়বে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে। তাই নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিৎ নারী শিক্ষা বিস্তার। – নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীর উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব। – নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা। – নারীর নিরাপদ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। – রাজনৈতিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন করা। – নারী স্বার্থের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। – নারীর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সহায়ক সেবা প্রদান করা ইত্যাদি।

বাংলাদেশে নারী দিবস: বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে আসছে। নারী দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বাংলাদেশের সংবিধানে নারী দিবসের শিক্ষাসমূহের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। কেবল নারী হওয়ার কারণে যাতে কেউ বৈষম্যের শিকার না হয় তার আইনগত সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনে নারীর সুরক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে এবং নারীর নিরাপত্তায় বিশেষ বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান শিল্প পোশাক শিল্প, যার অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা এবং ন্যায্য মজুরী পাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ গুরুত্বের সাথে দেখে থাকে। যে নারী শ্রমিকদের মধ্য থেকেই দিবসটির উৎপত্তি হয়েছিল, বাংলাদেশে বর্তমানে সেরূপ নারী শ্রমিক রয়েছে কয়েক লক্ষ। নিউ ইয়র্কের সেদিনকার সূচ কারখানার নারী শ্রমিক ও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার নারী শ্রমিক যেন একই পথের অনুসারী। বাংলাদেশ প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে থাকে। কিন্তু এখানকার নারী পোশাক শ্রমিকেরা কতটা সুরক্ষিত তার প্রশ্ন থেকেই যায়। বাংলাদেশে নারীদের জন্য অনেক আইন ও বিধি বিধান থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এখনও নারীরা উপেক্ষিত। নারীদের গৃহস্থালী কাজের অর্থনৈতিক স্বীকৃতি নেই। তালিকাভুক্ত নয় এমন শিল্প কারখানার নারী শ্রমিকেরা পর্যাপ্ত সুরক্ষা পায় না। তাদের ন্যায্য মজুরীর অভাব, মাতৃত্বকালীন ছুটির অভাব, নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি লক্ষ্যণীয়। তবে এ সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। বাংলাদেশের নারী শ্রমিকেরা যে সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে এর পেছনে নারী দিবসের কিছুটা হলেও ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়।

দিবসটির সমালোচনা: বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিকেরা আজও নানা ভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশের রানা প্লাজা ও তাজরিন ফ্যাশনস এর দুর্ঘটনার পর দেখা গেছে, এতে হতাহতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। নারীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও মজুরী অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশেই নিশ্চিত হয়নি বলে মনে করা হয়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন কোনো উপকারে এসেছে বলে মনে হয় না। অনেকের মতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস বর্তমানে কেবল একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে, যার বাস্তব কোনো সফলতা নেই।

দিবসটির তাৎপর্য: বিশ্বজুড়ে নারীর অধিকার ও নারীদের অগ্রাধিকার একটি বহুল আলোচিত বিষয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ছিল নারীদের অধিকার, বিশেষত কর্মজীবী নারীদের অধিকার আদায়ের প্রথম প্রচেষ্টা। এর সূত্র ধরে নারীদের প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠীর। জাতিসংঘের মাধ্যমে সাক্ষরিত হয়েছে বিভিন্ন চুক্তি ও সনদ। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এসব চুক্তি ও সনদ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। অনেক ক্ষেত্রে নারীর সুরক্ষায় এসব চুক্তি-সনদ আইনে পরিণত হয়েছে। বাধ্য করেছে মালিকপক্ষ এবং সরকারকে নারীদের দাবী মেনে নিতে। তাই সমালোচনা থাকলেও আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম।

উপসংহার: আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের এক স্মারক দিবস। নারীর প্রতি অবিচার ও বৈষম্যের প্রতিবাদে এক বলিষ্ট পদক্ষেপ ছিল এই দিনটির আন্দোলন। যদি বর্তমানে আমরা নারীর ন্যায্য অধিকার ও চাহিদা পূরণ করতে পারি, তবেই দিবসটির উদযাপন সার্থক হবে।